কলকাতা (২০ ডিসেম্বর '২৫):- মদ্যপানের পর মাথা ধরা কমাতে নিজের ইচ্ছে মতো প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়ার অর্থ যকৃত বা লিভারের সর্বনাশ করা। সম্প্রতি এই রকমই এক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে 'ব্রিটিশ জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি'-তে। সংশ্লিষ্ট প্রকাশনাতে পরিষ্কারভাবে জানানো হয়েছে, "..অ্যালকোহল ও প্যারাসিটামল বিক্রিয়া করে লিভারে অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়, ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে 'হেপাটোটক্সিসিটি'।"
মদ্যপানের কারণে মাথাব্যথা ও দূর্বল বোধ করলে বেশিরভাগ মানুষই নিজের ইচ্ছে মত প্যারাসিটামল খেয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্যারাসিটামল ও অ্যালকোহলের যুগলবন্দীতে লিভারের অভ্যন্তরে উৎসেচকের মাত্রায় তারতম্য দেখা যায়। এরকম প্রায়শই হতে থাকলে লিভারের কোষ দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।
'হেপাটোটক্সিসিটি' বিষয়ে 'ডিসান হসপিটাল,কলকাতা'-র 'গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি' বিভাগের অন্যতম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ সুনীলবরণ দাস চক্রবর্তী প্রাঞ্জল ভাষায় জানিয়েছেন, "সাধারণ সময় হালকা জ্বর বা গা ম্যাচম্যাচ কিংবা ব্যথা নিরসনে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দু একটা 'প্যারাসিটামল' ট্যাবলেট খেলে কিছু বলার নেই, কিন্তু মদ্যপানের পর মাথা ধরা বা ম্যাথা ব্যথা কমাতে মোটেও প্যারাসিটামল খাওয়া উচিত নয়, এতে ভালো তো কিছু হয়ই না, উল্টে যকৃত বা লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ওষুধসেবীকেই গুরুতর সমস্যায় ফেলে দেয়। আমাদের দেশে 'সিরোসিস অফ লিভার' আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগের অসুস্থতার কারণ নির্দিষ্ট মাত্রার তুলনায় ইচ্ছে মত প্যারাসিটামল খাওয়া।"
আসুন এক নজরে একটু বুঝে নেওয়া যাক, মদ্যপানের পর চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কথায় কথায় মুড়ি মুড়কির মতো প্যারাসিটামল খেলে শরীরের অভ্যন্তরে কী কী ঘটনা ঘটতে পারে -
লিভার আমাদের শরীরের এমনই এক অত্যাবশ্যক ও শক্তিশালী অঙ্গ যে অল্পবিস্তর সমস্যা হলে তা নিজেই মেরামত করে নিতে পারে। কিন্তু লাগাতার মদ্যপান ও প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে থাকলে শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কোষ নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে। বিস্তর গবেষণার পর প্রমাণিত যে মদ্যপানের পাশাপাশি জ্বর ও ব্যথার ওষুধ প্যারাসিটামল খেলে লিভারের স্বাভাবিক কার্যকারিতার ক্রমশ কমতে শুরু করে। একে মদ্যপান তার উপর প্যারাসিটামল সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব পড়ে। এরপর লিভারের বিভিন্ন উৎসেচক নিঃসরণ বেড়ে ও কমে যাওয়ায় অত্যাবশ্যকীয় এই অঙ্গের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
প্রাথমিক অবস্থায় লিভারের অসুখের সেরকম নির্দিষ্ট কোনও উপসর্গ না থাকায় রোগী বুঝতে পারেন না। পরে যখন নানান সমস্যা শুরু হয় ততদিনে লিভারের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে যায়। তাই জ্বর বা অন্যান্য অসুখে চিকিৎসকের পরামর্শে অবশ্যই প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে, কিন্তু তাও নিজের ইচ্ছেমত নয়।
লিভারের কাজ করার ক্ষমতা কমে গেলে শুরুতে খাবারে অরুচি হয়, ওজন কমতে শুরু করে, গা বমি করে এবং বমি হতে পারে, মাথা ঝিমঝিম করে, কাজকর্মে উৎসাহ হারিয়ে যায়, দূর্বল লাগে। এই সময় লিভার সংক্রান্ত অ্যালবুমিন, অ্যালামাইন ট্র্যান্স অ্যামাইলেজ, অ্যাসপারটেট ট্র্যান্স অ্যামাইলেজ, অ্যালকালাইন ফসফেট বা এএলপি, টোটাল বিলিরুবিন বা টিবিআইএল ইত্যাদি পরীক্ষা করলে বোঝা যায় লিভারের কর্মক্ষমতা ঠিক আছে কিনা। এছাড়া ফাইব্রোস্ক্যান নামে একটা টেস্ট করার দরকার হতে পারে। এটা একটা ব্যথাহীন আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা, যা লিভারের ফাইব্রোসিস এবং ফ্যাট (সিএপি স্কোর)-এর মাত্রা জানতে ব্যবহার করা হয়। লিভারের সিরোসিস নির্ণয় করতে এই টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিস বা অ্যালকোহল জনিত লিভারের সমস্যায় এই টেস্ট করতে হয়। লিভারের উৎসেচকগুলোর মাত্রার হেরফের হলে সমস্যার কথা ভাবা হয়। প্রয়োজনে অন্যান্য পরীক্ষাও করতে হতে পারে। ক্রনিক কোনও অসুখের জন্যে টানা অনেকদিন কোনও ওষুধ খাবার প্রয়োজন হলে লিভার এনজাইম পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার।
ইদানীং নারী পুরুষ নির্বিশেষে উৎসবের সময় বা যে কোনও উপলক্ষ্যে মদ্যপানের প্রচলন বেড়েছে। গবেষণায় জানা গেছে যে অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের পর প্যারাসিটামল খেলে বিষাক্ত রাসায়ানিকের প্রভাবে লিভারের কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে যাঁদের লিভারের অসুখ আছে এবং নিয়মিত মদ্যপান করেন। যদিও এই নিয়ে আরও গবেষণা চলছে। সুস্থ থাকতে মদ্যপানে রাশ টানার পাশাপাশি নিজের ইচ্ছামতো যেকোনো ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস বন্ধ করুন।


Comments
Post a Comment