সেন্ট স্টিফেন স্কুলের পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে শিক্ষিকাদের উপর অপ্রত্যক্ষ যৌন হয়রানির অভিযোগ


হীরক মুখোপাধ্যায় 

কোলকাতা (৩ জুলাই '২২):- 'সেন্ট স্টিফেন স্কুল'-এর 'বারুইপুর শাখা-র পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে 'অপ্রত্যক্ষ যৌন হয়রানি' সহ একাধিক  অভিযোগের আঙুল উঠেছে। অভিযোগ তুলেছেন 'সেন্ট স্টিফেন স্কুল'-এর প্রাথমিক বিভাগের কয়েকজন শিক্ষিকা।  

বারুইপুর থানার বক্তব্য  :-

বারুইপুর থানার বক্তব্য অনুযায়ী, "শিক্ষিকাদের উপর অপ্রত্যক্ষ যৌন হয়রানি, জোর করে ধর্ম পরিবর্তন, বেতন আটকে রাখা সংক্রান্ত একাধিক আভিযোগে গত মাসের ৪ এবং ৫ তারিখ দুটো এফ আই আর জমা পড়েছে। বারাকপুর ডায়োসিস-এর সম্পাদক সুকল্যাণ হালদার, বারাকপুর ডায়োসিস-এর বিশপ সুব্রত চক্রবর্তী এবং সেন্ট স্টিফেন স্কুলের বারুইপুর শাখার অধ্যক্ষ পৃথ্বীরাজ চক্রবর্তী-র বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৪০৬, ৫০৯/৩৪ অনুযায়ী এফ আই আর নথিভুক্ত হয়েছে।"

বিহার লিগাল নেটওয়ার্ক-এর বক্তব্য :-

থানায় লিখিতভাবে অভিযোগ জমা করার পর প্রায় একমাস হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ধরা হয়নি তিন পদস্থ অভিযুক্তকে।

২৮ জুন 'কোলকাতা প্রেস ক্লাব'-এ এই বিষয়ে এক সাংবাদিক বৈঠক করে 'বিহার লিগাল নেটওয়ার্ক'-এর তরফ থেকে জানানো হয়,"যৌন হয়রানির মতো একাধিক বিষয়ে সাংঘাতিক অভিযোগ থাকলেও বারুইপুর থানার পুলিশ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন এখনো ঠুঁটো জগন্নাথের মতো বসে আছে।"

'বিহার লিগাল নেটওয়ার্ক'-এর তরফ থেকে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছে, " বারুইপুর থানার অকর্মণ্যতা দেখে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক ও জেলা সমাহর্তা, রাজ্য মহিলা আয়োগ, রাজ্য শ্রম আয়োগ সহ সংখ্যালঘু আয়োগ-এর কাছে সেন্ট স্টিফেন স্কুল-এর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে লিখিত অভিযোগ জমা করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী এবার হয়তো প্রশাসনের সদর্থক কিছু ভূমিকা দেখা যাবে।"

'বিহার লিগাল নেটওয়ার্ক'-এর তরফ থেকে আরো জানানো হয়েছে, "যে কোনো নিপীড়িতা মহিলাদের পেছনেই সুরক্ষা কবচ রূপে দাঁড়ায় আমাদের সংগঠন। এই দুই নিপীড়িতা শিক্ষিকাও আমাদের কাছ থেকে সুরক্ষা কবচ পাবেন।"

অভিভাবকদের বক্তব্য :-

যাদের বিরুদ্ধে থানা ও প্রশাসনের কাছে এই কদর্য অভিযোগ জমা পড়েছে সেই বারুইপুর সেন্ট স্টিফেন স্কুল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে মুখ না খুললেও বিদ্যালয়ে পাঠরতা অনেক ছাত্রীর অভিভাবক ও অভিভাবিকারা অভিযোগ তুলেছেন, "এখানে পাঠরতা অনেক ছাত্রীই বিভিন্ন ধরণের অব্যক্ত যৌন নির্যাতনের শিকার।"  

নিপীড়িতা শিক্ষিকাদের বক্তব্য :- 

ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বারুইপুর 'সেন্ট স্টিফেন স্কুল'-এর পরিচালন সমিতির দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার প্রাথমিক বিভাগের দুই শিক্ষিকার সাথে যোগাযোগ করা হল তাঁরা জানান, "যে তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিতভাবে অভিযোগ জানানো হয়েছে, তাঁদের প্রশাসনিক ক্ষমতার ভয়ে অন্যান্য অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাই তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, অন্যথায় বিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই হয়তো এই ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতেন।"

২ নিপীড়িতা শিক্ষিকা আরো জানিয়েছেন, "বিদ্যালয়ে গেলে আমাদের অনেক শিক্ষিকাকেই একান্তে ডেকে বলা হচ্ছে 'আমাদের ঘরে একান্তভাবে একটু সময়ও তো কাটাতে পারো।' কখনো বলা হচ্ছে, 'আমরা তো বন্ধু,'  কখনো বা আমাদের পিঠ ও শরীর স্পর্শ করার একটা অভব্য ঝোঁকও দেখা যাচ্ছে যা কখনোই কাম্য নয়।"

সেন্ট স্টিফেন স্কুলের বিষয়ে এইরকম ঘৃণ্য অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে মুখ খুলে জানিয়েছেন, "অতিমারীর সময় পড়ুয়ারা কে কেমন আছে সেই বিষয়ে বিদ্যালয় থেকে কোনোরকম খোঁজ খবর নেওয়া না হলেও ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে বিদ্যালয়ের বকেয়া প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে এদের লজ্জা তো লাগেইনি, উল্টে বিদ্যালয়ের ভেতরে শিক্ষিকাদের নিয়েও নোংরামো করতে এখন বিদ্যালয় প্রশাসকদের বাঁধছে না। এদের বিচার আদালতের চার দেয়ালের ভেতরে নয় বরং প্রকাশ্যেই হওয়া উচিত।" 

বারুইপুরে সেন্ট স্টিফেন স্কুলের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সুশাসনের পক্ষে মুখে যত কথাই বলুক না কেনো, বাস্তবে এই সব কথাই অন্তঃসারশূন্য। অন্যথায় শিক্ষিকাদের উপর যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরে কোনো থানাই এভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেনা। 

এই ধরণের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরেও যদি কোনো আধিকারিক চুপচাপ বসে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। নতুবা থানা আধিকারিক নিজে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছেন। 

জেলা প্রশাসনের বক্তব্য :-

বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে শিক্ষিকাদের উপর যৌন হয়রানি, সময় মতো বেতন না দেওয়া, ধর্ম পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়া, শরীর স্পর্শ করার প্রবনতা, কাজ হারানোর ভয় দেখানো সহ একাধিক বিষয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কাছে জানতে চাওয়া হলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, "সব কিছুই প্রশাসনের নজরে আছে।" 

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বক্তব্য :-

অন্যদিকে কোলকাতার খ্রিষ্টান সমাজের তরফ থেকে সংবাদ মাধ্যমকে আশ্বস্ত করে জানানো হয়েছে, " এখানে যাবতীয় অভিযোগের তীর তিনজনের দিকে। তিনজন পদস্থ ব্যক্তির বাইরে কারো বিরুদ্ধে কোনো কিছু অভিযোগ করা হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই তিনজনকে আগে অভিযোগ মুক্ত হতে হবে, তারপর তাঁদের কথা শোনা হবে। তবে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের উপর যৌন হয়রানির ঘটনা মুখ বুজে সহ্য করবে না খ্রিষ্টান সমাজ।"

Comments