উৎসবের মুহূর্তে পশুপ্রেমের চূড়ান্ত বার্তা দিতে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরছেন প্রকৃতি প্রেমিক সৌমেন্দু সাউ


হীরক মুখোপাধ্যায়

কোলকাতা (২২ অক্টোবর '২৩):- হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রে কোথাও বলা আছে 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর' কোথাও বা বলা আছে, 'যত্র জীব তত্র শিব'।
কিন্তু ধর্মের কথা আজ শোনে কজন, আর ঠিক সেই কারণেই মহাশক্তির আরাধনার সময়েও দিকে দিকে পশু নিপীড়ন ও পশুহত্যার ঘটনাগুলো যেকোনো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন এবং ধর্মভীরু জনগণকেই মানসিক ভাবে পীড়িত করে।

বাঙালির শ্রেষ্ঠতম উৎসব দুর্গোৎসবের শুভ মুহূর্তে সাধারণ জনগণকে কিছুটা হলেও পশুপ্রেম সম্পর্কে সচেতন করার মানসে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসতের যুবক সৌমেন্দু সাউ (Saumendu Sau) এবার এক অভিনব পদক্ষেপ নিয়েছেন।

সৌমেন্দু তার নিজের পাড়ার পুজো ছাড়াও বিভিন্ন স্থানের পুজোমণ্ডপের গায়ে দুটো বার্তা আটকে দিয়ে আসেছেন।
বার্তা দুটোর মধ্যে একটায় লেখা, "আপনার উৎসব, আপনার চারপাশে থাকা মানব বন্ধু, সমাজ বন্ধু, পশুপাখিদেরও উৎসব।"
অন্যটায় লেখা, "উৎসবে ওদের সামিল করুন, উৎসবের খরচ কিছুটা বাঁচিয়ে তাদের আহার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।"


সৌমেন্দুকে ওঁর পাড়ার লোকেরা 'কুকুর প্রেমী' (Dogs lover) বলেই বেশি চেনেন। যদিও সৌমেন্দু-র নিজের মতে "ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রকৃতি প্রেমিক (Nature lover), তবে কেউ যদি পশুপ্রেমিক (Animals lover)ও ভাবেন তাও মন্দ নয়, তবে শুধুমাত্র 'কুকুর প্রেমী' রূপে দেগে দেওয়াটা বোধহয় ঠিক নয়।"

সৌমেন্দুবাবুর নিজের পাড়া ও এলাকার অন্যান্য পাড়ার ছেলেদের মতে, "ও শুধু পথের কুকুরদের নিজের টাকায় খাওয়ার ব্যবস্থা করে তাই নয়, প্রয়োজন পড়লে অন্য পশুদরদী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে এলাকার কুকুর, বিড়ালদের ভ্যাক্সিনেশন বা জন্মনিরোধক শল্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে।"

আজ এক খোলামেলা আড্ডায় অংশ নিয়ে সৌমেন্দু জানিয়েছেন, "একদিকে দেবদেবীদের বাহন রূপে আমরা কুকুর, বিড়ালদের লোকদেখানো পুজো করব, আর পরক্ষণেই তাদের উপর অত্যাচার চালাব, প্রাণে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া চালাব, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি আমার পাড়া সহ পাশাপাশি এলাকার মানুষের কাছে করজোড়ে শুধু এটাই বলছি, 'ওদেরও সুস্থভাবে বাঁচতে দিন'।"

এই মুহূর্তে দেশ তথা আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ভক্তি সহকারে দুর্গোৎসব চলছে।
দেবদেবীদের দিকে তাকালেই তাঁদের বাহন রূপে সিংহ, প্যাঁচা, ইঁদুর, রাজহাঁস ও ময়ুরকে দেখা যায়, এর পাশাপাশি শিবের বাহন ষাঁড়, কৃষ্ণ নিজেই তো গো-পালক, কালভৈরবের বাহন কৃষ্ণ সারমেয় (কালো কুকুর), ষষ্ঠী-র বাহন বিড়াল, শীতলার বাহন গাধা, বিশ্বকর্মার বাহন হাতি এছাড়াও আমাদের বিভিন্ন পুরানে দেবদেবীদের একাধিক বাহনেরও উল্লেখ আছে।

কথার ফাঁকে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে সৌমেন্দু জানিয়েছেন, "আমরা প্রত্যেক পুজোতেই দেবদেবীর সাথে সাথে মর্যাদা সহকারে তাঁদের অস্ত্র এবং বাহনদেরও পুজো করি, কিন্তু বাস্তব জীবনে তাঁদের বাহনদের সামান্যতম মর্যাদাও দিই না।

কোলকাতার রাস্তায় যেমন কিছু ব্যবসায়ীকে খেতে না পাওয়া শীর্ণকায় ও ক্ষতবিক্ষত এবং রক্তাক্ত ঘোড়ার গাড়িতে সওয়ার তুলে ব্যবসা করতে দেখা যায় ঠিক তেমন ভাবেই বিভিন্ন এলাকায় কুকুর, বিড়ালের উপরেও যথেষ্ট অত্যাচার হয়।"

যদিও সৌমেন্দু-র এই মহতী প্রয়াস যে খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা অন্তত ওঁর নিজের পাড়া ঘুরেও মনে হল না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বয়স্ক লোকের কথায়, "ছাড়ুন তো ওঁদের কথা, বারাসাত লাগোয়া এক শহরের এমন এক তথাকথিত মহিলা পশুপ্রেমীর নাম আমি নিজেই শুনেছি, যিনি বাস্তবে কসাই-এরও অধম।
ভদ্রমহিলা প্রথমে এলাকার রাস্তা থেকে সামান্য অসুস্থ পশুদের সংগ্রহ করে নিজের টাকা খরচ করে বাড়ি নিয়ে যান। তারপর চিকিৎসার বদলে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে পশুদের যন্ত্রণা ক্লিষ্ট চোখমুখ ও রক্তাক্ত অঙ্গের ছবি তুলে সেগুলো এদিক ওদিক পাঠিয়ে তহবিল সংগ্রহ করেন।
তহবিল সংগ্রহের শেষে ওই নিরীহ পশুটা তার নিজের জীবনী শক্তিতে বাঁচলে ভালো, নাহলে শেষ রাস্তাও তো খোলা আছে...।"

কেউ অজ্ঞানতার কারণে মানুক চাই না মানুক, বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য পশুপাখিদের সুস্থ অবস্থায় জীবিত থাকাটা একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীতে বর্তমানে একদিকে যেমন বনাঞ্চল কমছে, তেমনই জলজ ও স্থলজ পশুপাখিও মানুষের অত্যাচার বা ভোগ লালসার কারণে প্রতিদিন যথেচ্ছ হারে মারা যাচ্ছে, এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে  খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে গিয়ে সমাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।

অন্যদিকে পশুপ্রেমীর ছদ্ম মুখোশ পরে কেউ যদি প্রকৃত অর্থেই দুর্নীতি বা ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত থাকেন তবে তাঁরও দণ্ড বিধান একান্ত আবশ্যক, অন্যথায় ভবিষ্যতে প্রকৃত সমাজসেবীরাও সৌমেন্দুর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতি পদক্ষেপে সমাজ থেকে হেয় হতে বাধ্য। 

Comments