নারী ক্ষমতায়নের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত নারী জাতির অর্থনৈতিক বিকাশ


হীরক মুখোপাধ্যায় 

কোলকাতা (২২ মার্চ '২৩):- অর্থনৈতিক প্রগতি ছাড়া যেমন কোনো পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না, ঠিক তেমন অর্থনৈতিক বিকাশ ছাড়া 'নারী ক্ষমতায়ন' শব্দবন্ধটাও পুরোপুরি মূল্যহীন এমনই মনে করেন এযুগের উচ্চ শিক্ষিত বিদুষী মহিলারা।

যতই খাদ্য, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হোক না কেনো, যতক্ষণ না দেশের প্রত্যেক মহিলার হাতে সম্মানজনক অর্থ থাকবে ততক্ষণ 'নারী ক্ষমতায়ন' কথাটা শুধুমাত্র কথার কথাই থেকে যাবে বলে মনে করেন মিসেস এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল ২০১৩ কার্লি বোস (Curley Bose, Mrs. Asia International 2013) ও অবাঙালি নৃত্যশিল্পী শ্রীললিতা (Shreelalita, Renowned Dancer)-র মতো স্বাবলম্বী মহিলাগণ।

এই মুহুর্তে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি তথা বাঙালীর প্রেমে মজে আছেন দুই পূর্ণবয়স্কা নারী। একজন অনাবাসী ভারতীয় ও অন্যজন হায়দরাবাদের বাসিন্দা।
বাংলা ও বাঙালী প্রেমে মাতোয়ারা অনাবাসী ভারতীয় মহিলার প্রথম লক্ষ্য যেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নির্মাণ করে বাংলার উন্নয়ন ও উন্নতি কল্পে ঝাঁপিয়ে পড়া, সেখানে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির অপার সাগরে নিমজ্জিত থেকে সুধা পান করাই হায়দরাবাদী মহিলার এক ও একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।

গতকাল দক্ষিণ কোলকাতার এক আস্তানায় বাংলা তথা বাঙালী প্রেমী দুই নারীকে পাওয়া গেল একসাথে।
দুই সন্তানের জননী কার্লি বোস দীর্ঘদিন যাবত আমেরিকায় বসবাস করছেন। ওখানকার তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের সাথে জড়িত এই স্বাবলম্বী মহিলা ২০১৩ সালে 'মিসেস এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল' খেতাবেও সম্মানিত হয়েছেন।
অন্যদিকে হায়দরাবাদের অধিবাসী তথা নৃত্যশিল্পী শ্রীললিতা অবাঙালি হয়েও যেভাবে বাংলা নাটক, যাত্রা, চলচ্চিত্র তথা সংস্কৃতির টানে যেভাবে নিজের শহর ছেড়ে বারংবার কোলকাতায় চলে আসেন তা দেখলে বা ভাবলেও বাঙালী রূপে গর্ব অনুভব করতে হবে।

কথায় বলে 'শরৎ-রবি-বঙ্কিম-নজরুল এঁদের নিয়েই বাংলা সাহিত্য মশগুল', কথাটা বোধহয় অংশত ঠিক। শ্রীললিতা-কে সামনে থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না যে শুধু বাংলা নয় 'শরৎ-রবি-বঙ্কিম-নজরুল'-কে নিয়ে আজও মেতে আছে আসমুদ্রহিমাচল। আর তাঁদের সাহিত্য সম্ভারের টানেই যেন শ্রীললিতা-র বারবার বাংলায় ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।
পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারত থেকে এখন অনেকেই দক্ষিণ ভারতে ঘুরতে যান। ওখানকার সঙ্গীত, নৃত্য, চলচ্চিত্র, খাদ্য ও আতিথেয়তার প্রশংসায় যখন প্রায় সবাই পঞ্চমুখ, তার বিপ্রতীপে শ্রীললিতা-র মুখে বাংলার রকমারি মিষ্টি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা সত্যিই বাঙালীদের মনে সুখানুভূতি এনে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
শ্রীললিতা বাংলায় এসে শিখেছেন ওডিশি নৃত্যশৈলী, পরে নিজের রাজ্যে গিয়ে দক্ষিণ ভারতীয় বিভিন্ন নৃত্যশৈলীর সাথে মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক নতুন রূপে তিনি দর্শকদের উপহার দিচ্ছেন তাঁর নৃত্যশিল্প।
ভিনদেশীর কাছে গানের কথার থেকে সুর যেমন তাকে আকৃষ্ট করে, ঠিক সেভাবেই বাংলা ভাষাকে ঠিকভাবে বোঝার আগে নাটক, যাত্রার শিল্পীদের শারীরিক ভঙ্গি শ্রীললিতা-কে বেশি আকর্ষিত করেছিল; আর সেই অমোঘ আকর্ষণ দিন দিন তাঁকে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত করে ফেলেছে।
এখনো সেভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ না করলেও বাংলা ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর অন্ততঃ কোনো সমস্যা নেই।

শ্রীললিতা-র মতে "পরিশীলিত নারী স্বাধীনতা ও নারীকে তার প্রাপ্ত শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে দেওয়ার মানসিকতা সামাজিক উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি হতে পারে।"

অবাঙালি মহিলা শ্রীললিতা-র পাশাপাশি জন্মসূত্রে হাওড়ার মেয়ে বর্তমানে অনাবাসী ভারতীয় কার্লি বোস এখন এই বাংলাকে যত দেখেন ততই আশ্চর্যচকিত হন।
তাঁর ছোটবেলার পশ্চিমবঙ্গের সাথে এই মুহুর্তের পশ্চিমবঙ্গকে মেলাতে পারেননা। আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন, "আমাদের সময়ের তুলনায় এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে উন্নতি তো হয়েইছে।"

বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রশংসা করার পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছেন, "একজন মা'ই পারেন একটা সুস্থ সমাজের জন্ম দিতে। তাই একদম প্রথম থেকেই নারীদের সার্বিক বিকাশ তথা উন্নতির দিকে রাজ্য তথা দেশকে মনোনিবেশ করতে হবে।
জন্মাবার পর থেকে প্রত্যেক মেয়ে যাতে পুষ্টিকর খাদ্য, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা, প্রথাগত এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সেই দিকে রাষ্ট্রকেই আগে লক্ষ্য রাখতে হবে।"

কথা প্রসঙ্গে কার্লি কিঞ্চিত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, "আরো উন্নয়ন প্রয়োজন, আরো বেশি করে মহিলাদের ক্ষমতায়ন দরকার। যতক্ষণ না আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো হবে ততদিন সমাজে নারী পীড়নের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপ চলতেই থাকবে।"

কার্লি সম্ভবতঃ ঠিকই বলেছেন। বহির্বিশ্বের নিরিখে যখন বাংলাকে দেখা যায় তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যিই লজ্জা বোধ হয়।
এখনো বাংলার মেয়েরা সেভাবে উপযুক্ত শিক্ষা পায় না, নেই সেইরকম সামাজিক সম্মান বা রোজগার। ফলতঃ একটা হীনমন্যতা বোধ তাঁদের তাড়িত করে, আর মহিলাদের এই হীনমন্যতা বোধকেই শিক্ষিত পুরুষ সমাজ অনেকাংশে 'স্ত্রীসুলভ লজ্জা' আখ্যা দিয়ে নজর ঘোরাতে চান।
শুধুমাত্র লোকসভা, রাজ্যসভা বা বিধানসভায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করলেই হবেনা। সংখ্যালঘু বা তফশিলি কোঠার আসন সংরক্ষণ তুলে শিক্ষা ও কর্মজগতে পুরুষ মহিলাদের মধ্যে সমহারে আসন সংরক্ষণ নিঃসেন্দহে মহিলা ক্ষমতায়নের আদর্শ চিন্তা হতে পারে।

দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটাবার পরেও কার্লি আজও ভুলতে পারেননি বাংলাকে। আর ঠিক সেই কারণেই তাঁর একসময়ের সহপাঠীর হাত ধরে বাংলায় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার গোড়াপত্তন করতে চান কার্লি।
কার্লি-র সহাস্যময় বক্তব্য, "হ্যাঁ এ কথা ঠিক যে আগের তুলনায় বেশ কিছুটা কাজ হয়েছে, তবে আরো অনেক অনেক কাজ এখনো বাকি পড়ে আছে। সেগুলোও করতে হবে।
মহিলাদের আত্মসচেতনতা ও আত্মনির্ভরতা বাড়ানোর জন্য মহিলাদের সার্বিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রোজগারের দিকে অবিলম্বে নজর দেওয়া প্রয়োজন।"

Comments