সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের লেঃ জেনারেল রাণাপ্রতাপ কালিটার উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে শুরু হল ফাটাকেষ্টর কালীপুজো


হীরক মুখোপাধ্যায় 

কোলকাতা (২২ অক্টোবর '২২):- সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের শীর্ষ আধিকারিক (GOC-in-C Eastern Command) লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাণাপ্রতাপ কালিটা (Lt. General Rana Pratap Kalita)-র উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে শুরু এবারের হল ফাটাকেষ্টর কালীপুজো।

সাবেক রীতি রেওয়াজ মেনে ভক্তি শ্রদ্ধা সহযোগে ধন ত্রয়োদশী-র পবিত্র তিথিতে জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হল উত্তর কোলকাতার বহুচর্চিত 'ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজো'-র মণ্ডপ।

এই বছর 'ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজো' ৬৫ তম বর্ষে পদার্পণ করল। প্রবন্ধ রায় ওরফে ফ্যান্টা-র নেতৃত্বে কোলকাতার 'সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট'-এ সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে ফাটাকেষ্ট নামাঙ্কিত এই কালীপুজো। 


লেঃ জেনারেল রাণাপ্রতাপ কালিটা-র সাথে আজ উদ্বোধনী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস-এর বর্ষীয়ান সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (MP Sudip Bandyopadhyay), বিধায়ক মুকুল রায় (MLA Mukul Roy), বিধায়ক তাপস রায় (MLA Tapash Roy), অন্যতম নেতা সঞ্জয় বক্সি (Sanjoy Boxi) সহ এলাকার তিন পৌরপ্রতিনিধি সুপর্ণা দত্ত (Councillor Suparna Dutta), সাধনা বসু (Councillor Sadhana Bosu) ও স্বপন সমাদ্দার (Councillor Swapan Samaddar) সহ একাধিক বরেণ্য অতিথিবৃন্দ।

আজ নবীন ও প্রবীণ সবাই একডাকে 'ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজো'-কে চিনে থাকলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই 'ফাটাকেষ্ট'-র সম্পর্কে সেভাবে ওয়াকিবহাল নন। আসুন পুজোর কথা শোনার ফাঁকে জেনে নিই ফাটাকেষ্ট সম্পর্কে।

কে এই ফাটাকেষ্ট :- 

কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে কেষ্ট (Krishna Chandra Dutta @ Keshto) একসময় লোকমুখে 'ফাটাকেষ্ট' (Fatakeshto) রূপে খ্যাত হয়ে ওঠেন। 

কেষ্টর ফাটাকেষ্ট হয়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত কাহিনী:-

কেউ বলেন বসন্ত বা স্মলপক্সের কারণে কেষ্ট-র মুখ ছিল ক্ষতবিক্ষত সেই কারণেই তাঁর কাছের লোকেরা তাঁকে 'ফাটাকেষ্ট' বলে ডাকতে শুরু করেন। 

যদিও অন্য মতে, কোলকাতার 'নরসিংহ লেন'-এর পাড়াতুতো শত্রু নকুল বরানগরের নীলু-কে সাথে নিয়ে কেষ্ট-কে জানে মারার জন্য একবার তাঁর উপর চড়াও হয়েছিলেন।

আচমকা আক্রমণ কেষ্ট রুখে দিতে পারলেও শত্রুদলের অগুনতি ছোরার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল কেষ্টর শরীর। এই ঘটনার পর কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি আসার পর সারা শরীরে কাটা ছেঁড়ার দাগ থাকার জন্য স্থানীয় জনগণের কাছে তিনি 'ফাটাকেষ্ট' রূপে পরিচিতি লাভ করেন।

কেষ্টর বীরত্ব :- 

একবার কোলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিট-এর জনৈক গুণ্ডা 'গণ্ডার' ফাটাকেষ্ট-কে লক্ষ্য করে একটা বোমা ছোঁড়েন। বরাতজোড়ে সেই বোমা তৎক্ষনাত না ফাটায় ফাটাকেষ্ট সেই বোমা নিজের হাতে নিয়ে 'গণ্ডার'-এর দিকে ছুঁড়ে মারেন। পরের ঘটনা সহজেই অনুমেয়। 

ফাটাকেষ্টর কালীপুজোর ইতিহাস:- 

প্রথমে এই পুজো শুরু হয়েছিল কোলকাতার 'গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেন'-এ পরবর্তী সময়ে ফাটাকেষ্টর জীবদ্দশাতেই এই পুজো স্থানান্তরিত হয় কেশব সেন স্ট্রিট লাগোয়া 'সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট'-এ।

কবে থেকে ফাটাকেষ্টর পুজোর উত্থান :- 

লোকোক্তি অনুযায়ী কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে কেষ্ট ওরফে ফাটাকেষ্ট ছিলেন কংগ্রেসী মনোভাবাপন্ন। স্থানীয় অন্য কংগ্রেসী নেতা সোমেন মিত্র-কে কিছুটা চাপে রাখার জন্য সোমেন বিরোধী কংগ্রেসী শিবিরের অঙ্গুলিনির্দেশ ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজোর রমরমা শুরু হয়।

যদিও রাজ্য তথা কোলকাতার ইতিহাস বলছে, ১৯৭০ সাল নাগাদ কোলকাতায় নকশালদের প্রভাব ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে উঠেছিল। রাজ্যের মানুষ ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছিলেন। এই সময় দৃঢ়চেতা কংগ্রেসী নেতা কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে কেষ্ট নকশালদের এই কোলকাতাতেই ভয়ঙ্কর শক্ত প্রতিরোধের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। শিয়ালদার অন্য কংগ্রেসী নেতা সোমেন মিত্রের সাথে এক হয়ে নকশালদের এই অঞ্চলে একবারে দমিয়ে দেন কেষ্ট। এলাকায় রবিনহুড ইমেজ পেয়ে যাওয়ার পরেই কেষ্টর কালীপুজোর কথা আস্তে আস্তে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।

ফাটাকেষ্টর কালীপুজোর বিশেষত্ব :- 

চাকচিক্য বা আড়ম্বরের পরিবর্তে ভক্তি শ্রদ্ধার মিশেলে ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে মাতৃ আরাধনাই এখানকার পুজোর বিশেষত্ব। তাই এলাকার অন্যান্য পুজো আয়োজকগণ যখন 'থিম' ও 'মাতৃমূর্তি'-র অবয়ব নিয়ে নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ব্যস্ত, তখন সাবেকিআনাই ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজোর বড়ো বৈশিষ্ট্য।

অতীতে পুজোতে কারা এসেছেন :- 

একটা সময় ছিল যখন বলিউড টলিউডের নামকরা প্রায় সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের পাশাপাশি ধর্মীয় জগতেরও যশস্বী ব্যক্তিরা এই পুজো মণ্ডপ ঘুরে গেছেন।

'নব যুবক সংঘ'-র অতীত ইতিহাস বলছে এই পুজোতে অমিতাভ বচ্চন ঘুরে গেছেন দু বার। উত্তমকুমার তো আমৃত্যু প্রত্যেক বছরেই এসেছেন।

এছাড়াও এসেছেন দেবানন্দ, রাণী মুখার্জি, আশা ভোঁসলে, আর ডি বর্মন, রাজেশ খান্না, হেমা মালিনী, বিনোদ খান্না, শত্রুঘ্ন সিনহা, মহাভারত ধারাবাহিকের সমস্ত চরিত্রাভিনেতা ও চরিত্রাভিনেত্রীগণ, বাপ্পি লাহিড়ী সহ একাধিক ব্যক্তি।

পুজো সম্পর্কিত কিছু ঘটনা :-

'দো-আনজানে' ছবির দৃশ্যগ্রহণ করার জন্য একবার অমিতাভ বচ্চন কোলকাতায় এসেছিলেন। সেই সময় কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে কেষ্ট ওরফে ফাটাকেষ্ট সরাসরি বচ্চনের সামনে গিয়ে তাঁকে পুজো দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানান। 

রাত ১০ টার পর মণ্ডপে আসেন অমিতাভ বচ্চন। পরে তিনি মায়ের উদ্দেশ্যে ৭৫ হাজার টাকা দামের একটা হীরের নাকছাবি পাঠিয়ে দেন।

যদিও সেই নাকছাবি এলাকারই এক ছেলে চুরি করে স্থানীয় এক স্বর্ণকারের কাছে বেচে দেয়, পরে ঘটনা জানাজানি হলে স্বর্ণকার সোনার দাম ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলেও সোনা গলিয়ে ফেলার জন্য প্রকৃত নাকছাবিটা আর উদ্ধার হয়নি।

ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজোতে অনেক মহিলার শরীরে মায়ের আবেশ (ভর) হয় বলে লোকোক্তি থাকলেও ফাটাকেষ্ট-র কালীপুজোর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সোমেন মিত্র বরাবরই ওই ঘটনাকে অস্বীকার করে বলে এসেছিলেন, "ওগুলো একটু ইয়ে ..।"

নকশাল আন্দোলনের সময় ফাটাকেষ্ট আর সোমেন হাত মিলিয়ে কোলকাতায় নকশালদের বাড়বাড়ন্ত রুখে দেওয়ার ফলে নকশালদের রাগ গিয়ে পড়ে ফাটাকেষ্ট আর সোমেন-এর কালীপুজোর উপর। একসময় এমনও হয় যে কুমোরটুলি এবং বি কে পাল অ্যাভিনিউ জুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আয়োজন করার ছক কষে নকশালরা।

নকশালদের এই নীল নকশা আগে থেকে জেনে যাওয়ার কারণে সেবার কুমোরটুলি-র মাধব পাল-এর ঘর থেকে অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই মাকে তুলে নিয়ে এসে নকশালদের ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন ফাটাকেষ্ট, যদিও সেবার সোমেন মিত্র-র প্রতিমা মঞ্চে পৌঁছে দিতে পুলিসের নাভিশ্বাস উঠেছিল।

সেবারই প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন কাকভোরে নিমতলা ঘাটে মাকে সফলতার সাথে জলশয্যায় শায়িত করে নকশালদের আবার বুদ্ধির দৌড়ে বুদ্ধু বানিয়ে ছেড়েছিলেন মূলতঃ ক অক্ষর গোমাংস ফাটাকেষ্ট। যদিও পুলিসের হাজার সহযোগিতা পেলেও বিসর্জনের সময়েও সোমেন মিত্র-কে সেবার যথেষ্ট নাকানিচোবানি খেতে হয়েছিল।

১৯৯২ সালে হৃদরোগে ফাটাকেষ্টর মৃত্যু হওয়ার পর বর্তমানে এই পুজোর গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন প্রবন্ধ রায় ওরফে ফ্যান্টা (Probandho Roy @ Fanta)।

Comments